দারসুল কুরআনঃ সুরা আলে ইমরান (আয়াত: ১০২)

 



আরবী:

 یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰهَ حَقَّ تُقٰتِهٖ وَ لَا تَمُوۡتُنَّ اِلَّا وَ اَنۡتُمۡ مُّسۡلِمُوۡنَ


·       Translation:

O you who believe, fear Allah, as He should be feared, and let not yourself die save as Muslims.


অনুবাদ:

হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় কর, যেভাবে ভয় করা উচিত। আর মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। (সুরা আলে ইমরান: ১০২)


সুরা পরিচিতি:

সুরার ক্রম: ৩

মোট আয়াত: ২০০

মোট রুকু: ২০

সিজদাহ: নাই

পারা: ৩-৪

অবতীর্ণ: মদিনা।


নামকরণ:

এ সুরার ৩৩ নং আয়াতে উল্লেখিত إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَى آَدَمَ وَنُوحًا وَآَلَ إِبْرَاهِيمَ وَآَلَ عِمْرَانَ عَلَى الْعَالَمِينَ   (নিশ্চয় আল্লাহ আদমকে, নুহকে, ইব্রাহিমের পরিবারকে এবং ইমরানের পরিবারকে বাছাই করেছেন বিশ^বাসীর জন্য) এখান থেকে সুরার নাম হয়েছে ‘আলে ইমরান’ যার অর্থ ইমরানের পরিবার। ইমরান আ. এর পুরো নাম ইমরান বিন লাখাম। তার স্ত্রীর নাম হান্না বিনতে ফাকুজ। ইমরান হচ্ছেন মরিয়ম আ. এর পিতা, ঈসা আ. এর নানা, অনেকের মতে মুসা আ. পিতার নামও ইমরান ছিল। অধিকাংশ সুরার মতো এ সুরাটির নামকরণও  নিচক একটি শব্দ থেকে হয়েছে, বিষয়বস্তু থেকে নয়। তবে বেশিরভাগ নবীর আগমন হয়েছে ইব্রাহিম আ. এবং ইমরান আ. এর পরিবার থেকে। প্রায় ৭০,০০০ নবী ইব্রাহিম আ. এর বংশধর এবং প্রায় ৪০,০০০ নবী ইমরান আ. এর বংশধর। সেই দিক থেকে সুরার নাম ‘আলে ইমরান’ করা যথার্থ।


নাযিল হওয়ার সময়কাল:

এ সুরাটি মূলত ৪টি ভাষণের সমষ্টি। ১ম ভাষণটি ১ম রুকু থেকে ৩য় রুকু (১-৩২ আয়াত) পর্যন্ত। এটি নাযিল হয়েছে বদর যুদ্ধের নিকটবর্তী সময়ে। ২য় ভাষনটি ৪র্থ থেকে ৬ষ্ঠ রুকু (৩৩-৬৩ আয়াত) পর্যন্ত। এটি সে সময়ে নাযিল হয়েছে, যখন ৯ম হিজরীতে নাজরানের প্রতিনিধি দল রাসুলুল্লাহ সা. এর কাছে আগমন করে। ৩য় ভাষণটি ৭ম থেকে ১২শ রুকু (৬৪-১২০ আয়াত) পর্যন্ত, যা ১ম ভাষণের কাছাকাছি সময়ে নাযিল হয়। আর ৪র্থ ভাষণটি ১৩শ থেকে ২০শ রুকু (১২১-২০০ আয়াত) পর্যন্ত। এটি নাযিল হয়েছে উহুদ যুদ্ধের পর। সুতারাং নাযিলের সময় অনুসারে এটি ‘মাদানী’ সুরা।


বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য:

এই সুরায় দুটি দলকে সম্বোধন করা হয়েছে। একটি হলো আহলে কিতাব (ইহুদী ও খ্রিষ্টান), আরেকটি হলো মুসলমান। সুরা বাকারায় ইসলাম প্রচারের যে ধারা শুরু হয়েছে এ সুরায় তার অব্যাহত বর্ণনা করা হয়েছে। সে হিসেবে একে সুরা বাকারার পরিশিষ্টও বলা যায়। এ সুরায় আহলে কিতাবের আকিদার ভ্রষ্টতা, চারিত্রিক দুষ্কৃতি সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। তাদের আরো বলা হয়েছে তারা যে মুহাম্মদ স. ও সত্য দ্বীনের  বিরোধীতা করছে, তার আগমনের খবরই সকল নবী রাসুল তাদের উম্মতের কাছে দিয়েছেন। আর উম্মতে মুহাম্মদীকে শ্রেষ্ঠতম জাতি হিসেবে বিশ^ মানবতার সংস্কারের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের এ কাজের পথে বাঁধা সৃষ্টিকারী শক্তির সাথে কি আচরণ করতে হবে তা বলে দেয়া হয়েছে। এছাড়া উহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের মধ্যে যে দূর্বলতা দেখা দিয়েছিল তা দূর করার জন্য সতর্ক করা হয়েছে।


আনুষাঙ্গিক বিষয়:

১. এ সুরাটি একজন নবীর নামে নামকরণ করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে নবীদের নামে আরো ৬টি সুরা আছে। যথা-(১০) ইউনুস, (১১) হুদ, (১২) ইউসুফ, (১৭) বনী-ইসরাঈল (ইয়াকুব), (৪৭) মুহাম্মদ, (৭১) নুহ।

২. এ সুরা শুরু হয়েছে الٓمَّٓ (আলিফ-লাম-মীম) দিয়ে। এগুলোকে বলা হয়, হরফে মুকাত্ত¡য়াত বা আয়াতে মুতাশঅবিহাত। পবিত্র কুরআনে মোট ২৯ টি সুরা আয়াতে মুতাশাবিহাত দিয়ে শূরু। এর মধ্যে ৬টি সুরা শুরু হয়েছে الٓمَّٓ দিয়ে। এ আয়াতগুলোর অর্থ আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। (সুরা আলে ইমরান: ৭)


ফজিলত:

১. প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি সুরা বাকারা এবং সুরা আল ইমরান জুমআর রাতে তথা বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে পাঠ করবে, আল্লাহ তাআলা তাকে সাত আসমান ও সাত জমিন পর্যন্ত সাওয়াব দান করবেন।’ (খোলাসাতুত তাফসির)

২. অন্য হাদিসে এসেছে, ‘কেয়ামতের দিন কুরআন আসবে যারা কুরআনের ওপর আমল করেছে তাদের পক্ষ হয়ে। তখন সুরা বাকারা ও সুরা আলে ইমরান থাকবে সবার আগে।’ (মুসলিম)


শব্দ ভিত্তিক ব্যাখ্যা:

এ আয়াতের প্রত্যেকটি শব্দই গুরত্বপূর্ণ। এজন্য শব্দ ভিত্তিক ব্যাখ্যার প্রয়োজনীতা অনুভব করছি:


یٰۤاَیُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا 

‘‘হে ঈমানদারগণ”

-এভাবে সম্বোধনের মানে হলো এখানে যে নির্দেশনা আল্লাহ তায়ালা দিচ্ছেন তা কেবলমাত্র ঈমানদারদের জন্যই খাস।

-ঈমান হলো মৌলিক ৭টি বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা, যা তিনটি বিষয় তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতের সাথে যুক্ত।

-ঈমান হলো ৩টি বিষয়ের সমন্বিত ফলাফলঃ ১.ইকরার বিল লিসান বা মুখে স্বীকৃতি

২.তাশদীদ ফিল জিনান বা অন্তরে বিশ্বাস 

৩.আমল বিল আরকান বা কাজে পরিণত করা। 

-রাসুলুল্লাহ সা. নবুয়াতের ১৩ বছর শুধু ঈমানেরই দাওয়াত দিয়েছেন।

-ইলম (জ্ঞান) ছাড়া ঈমান পরিপূর্ণ হয় না। ‘রব্বানা ইন্নানা সামিনা মুনাদি আঁই ইউনাদি লিল ঈমান আন আমিনু বিরব্বিকুম ফা আমান্না (আলে ইমরান: ১৯৩)

-ঈমানেই বাতিলের সাথে মুমিনের শত্রæতার কারণ। ‘ওমা নাকামু মিনহুম ইল্লা আই ইয়ুমিনু’ (সুরা বুরুজ: ৭)

-আল্লাহ ডাক দিলে ঈমান নড়ে উঠে। ‘ইন্নামাল মুমিনিনাল্লাযিনা ইযা জুকিরাল্লাহি ওজিলাত কুলুবুহুম (আনফাল: ২)

-ঈমানের মৌলিক দাবী ৩টি: 

১. প্রতিদিন ঈমান আনা: এতে করে ঈমানের ব্যপারে সন্দেহ দূর হয়। এই ঈমান তখন ইয়াকীন পর্যায়ে পৌঁছে। ইয়াকীন আবার তিন প্রকার: ইলমাল ইয়কীন, আইনাল ইয়াকীন, হাক্কুল ইয়াকীন। আমাদের ঈমান ইলমাল ইয়াকীন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। (সুরা তাকাসুর)

২. আমল করা: সর্বাবস্থায় ঈমানের পরিচায়ক কাজ করা এবং ঈমানের সাথে সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো থেকে দূরে থাকা। ঈমানের দাবী হলো সাধারণ জীবন যাপন করা। আরো চাই আরো চাই এটি হলো কুফরী জিন্দেগীর লক্ষণ। রাসুলুল্লাহ স. বলেন, ‘ইন্নাল বাজাজাতা মিনাল ঈমান’।

৩. ঈমানের উপর দন্ডয়মান হওয়া:  যারা ঈমান আনার পর তার উপর দন্ডয়মান হয় তাদের ভয় চিন্তার কোন কারণ নেই বরং রয়েছে জান্নাতের সুসংবাদ (হা-মীম-সাজদাহ: ৩০)

-ঈমানের বৈশিষ্ট্য হলো প্রয়োজনের আলোকে সাড়া দেয়া। গীতিকার আবদুস সালামের মতে,

‘যে ঈমান প্রয়োজনে জ্বলে ওঠে না, 

যে ঈমান সত্য ন্যায়ের কথা বলে না।

যে ঈমান অন্তরে নাই মুখে ফোটায় কথার কলি,

কিভাবে তারে বলো ঈমান বলি।’


শুধু কালিমার ঘোষনা দেয়ার নাম ঈমান নয়। বিশ্বকবি আল্লামা ইকবাল বলেন,

‘খেরাদ নেগার কে বিদিয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ তো কেয়া হাসিল,

দিল নিগা মুসলমানেহি তো কুচ বি নেহি।’


-ঈমানের পরীক্ষা হয় জিহাদের ডাক আসলে। কবি  মতিউর রহমান মাল্লিক বলেন,

‘কার কতটা ঈমান আছে 

সময় এলো পরীক্ষার, 

রণাঙ্গনের ডাক আসে ঐ 

লগ্ন তুলে প্রতীক্ষার’


 اتَّقُوا اللّٰهَ حَقَّ  تُقٰتِهٖ

‘‘আল্লাহকে ভয় কর, যেভাবে ভয় করা উচিত’’

-এই কথার মানে হলো আল্লাহকে ভয় করার মত ভয় কর। অর্থাৎ সকল কাজের ক্ষেত্রে তাকওয়ার নীতি অবলম্বন কর।

-সকল মৌলিক ইবাদতের মূল উদ্দেশ্য তাকওয়া। যেমন: সাওম পালন (সুরা বাকারা: ১৮৩), কুরবানী (সুরা হজ্জ: ৩৭)

-রাসুল্লাহ স. এর এমন কোন খোৎবা নাই যেখানে তিনি তাকওয়ার আয়াত বলেন নি।

-বিয়ের খোৎবায় তাকওয়ার আয়াত বেশী পড়া হয়। 

-আল্লাহর কাছে সে ব্যক্তি বেশী প্রিয় যে তাকওয়াবান। (সুরা হুজুরাত: ১০)

-পরকালীন পুঁজি অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে তাকওয়া। (সুরা হাশর: ১৮)

-জ্ঞানীরাই আল্লাহকে বেশী ভয় করে থাকে। (সুরা ফাতির: ২৮)

-আল্লাহ তায়ালা তাদের সাথে রয়েছেন যারা তাকওয়াবান। (সুরা নাহল: ১২৮)

-ক্ষমা ও সফলতা তাদের জন্য, যারা আল্লাহকে ভয় করে। (সুরা মূলক: ১২)

-আল্লাহর ভয় যুক্ত কাজে একে অপরকে সহায়তা করা উচিত। (সুরা মায়েদা: ২)

-জান্নাত তাদের জন্য যারা তাকয়াবান। (সুরা আম্বিয়া: ৬৩)

-যারা আল্লাহকে ভয় করে তাদেরকে আল্লাহ কল্পনাতীত রিযিক দান করেন। (সুরা ত্বালাক: ২-৩)

-যারা ঈমানদার ও তাকওয়াবান তাদের ভয় বা চিন্তার কোন কারন নেই। (সুরা ইউনুস: ৬২)

- আতিয়া আস-সাদী (রা.) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কোন ব্যক্তি পাপ কাজে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় যেসব কাজে গুণাহ নেই তা পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত খোদাভীরু লোকদের শ্রেণীভুক্ত হতে পারে না। (তিরমিযি ও ইবনে মাজাহ)

-আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, হে আয়েশা! ছোটখাট গুণাহের ব্যাপারেও সতর্ক হও। কেননা এ জন্যও আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। (ইবনে মাজাহ)

-তাকওয়া শুধুমাত্র বাহ্যিক পোশাক পরিচ্ছদের নাম নয়। রাসুল স. বলেন, ‘আত তাকওয়া হাহুনা ইলা ইশরাতা ক্বলবিহি’

-আল্লাহর কাছে বংশ বা সাদা কলোর কোন অগ্রধিকার নেই, তাকওয়া অগ্রাধিকারের একটাই মাপকাঠি। রাসুল স. বলেন, ‘লা ফাজলা লি আরাবিয়িন আলা আজমি ওলা আহমার আলা আসওয়াদ ইল্লা বিত তাকওয়া’

-গীতিকার বিল্লাল হোসাইন নূরী ভাষায়, 

‘‘যাদের হৃদয়ে আছে আল্লাহর ভয়, 

তারা কভু পথ ভুলে যায় না’’


وَ لَا تَمُوۡتُنَّ اِلَّا وَ اَنۡتُمۡ مُّسۡلِمُوۡنَ

‘‘মুসলমান না হয়ে মৃত্যবরণ করো না’’

-এই আয়াতাংশের মানে হলো পরিপূর্ণ মুসলমান না হয়ে মরণের না নিও না।

-‘মুসলমান’ মানে আত্মসমর্পনকারী। অর্থাৎ তার জীবনের সব কিছু আল্লাহর কাছে সমর্পিত করা।

-মুসলিম জাতির পিতা ইব্রাহিম আ. তা-ই করেছেন। ‘আসলিমতু ইয়া ইব্রাহিম, ক্বলা আসলামতু লি রাব্বিল আলামীন’

-আল্লাহ আমাদের সে পথে চলতে বলেছেন। ‘মিল্লাতা আবিকুম ইব্রাহিম হুয়া সাম্মাকুমুল মুসলিমীন।(হজ্জ: ৭৮)

-উত্তম স্ত্রীদের মৌলিক ৫টি বৈশিষ্ট্যের প্রথমটি হলো সত্যিকার মুসলিম। (সুরা তাহরীম: ৫)

-মুসলমান এক সংগ্রামী জাতির নাম। তারা শুধু আল্লাহকেই ভয় করে। কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেন,

‘‘মুসলিম আমি সংগ্রামী আমি আমি চির রণবীর, আল্লাহকে ছাড়া কাউকে মানি না নারায়ে তাকবীর’’

-মুসলমান হওয়ার মানেই হলো শাহাদাতের ময়দানে সামিল হওয়া। আল্লামা ইকবাল বলেন,

‘‘ইয়ে শাহাদাত গাহে 

উলফাত মে কদম রাখে না, 

লোক সমস্তে হে 

আসাহে মুসলমা হো না’’


মৌলিক শিক্ষা:

১. পায়ের প্রতিটি কদম, চোখের প্রতিটি পলক, কানের প্রতিটি শ্রুতি, মুখের প্রতিটি বুলির মধ্যে আল্লাহর ভয় সঞ্চার করা।

২. সকল শর্ত পূরন করে একজন পরিপূর্ণ মুসলমান হিসেবে নিজেকে তৈরি করা। 


Post a Comment

0 Comments

Close Menu